রাজধানীর মিরপুরে ফুটপাতের চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বে ফিল্মি স্টাইলে হামলা চালিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬নং ওয়ার্ড যুবলীগ কর্মী ইয়ামিন হোসেন রোমান হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তারা হলেন খুনের মূল পরিকল্পনাকারী পল্লবী থানা ৬ নং ওয়ার্ড কৃষকলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান বিপ্লব ওরফে কিলার বিপ্লব এবং তার অনুসারী মনিরুল হক ওরফে কাইয়ুম ও ফয়েজ আহমেদ। গত বুধবার রাতে পল্লবী থানা এলাকা থেকে বিপ্লবকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহষ্পতিবার পুরান ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হন কাইয়ুম ও ফয়েজ।
গত ৭ জানুয়ারি দুপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন যুবলীগকর্মী রোমান। ঘটনার পরপরই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত আজহারুল ইসলাম সবুজ নামে আরও একজন গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলায় এজাহারভুক্ত ২ জনসহ গ্রেপ্তার হলেন মোট ৪ জন।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে খুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ফয়েজ। দুই দিনের রিমান্ডের প্রথম দিনই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে ঘটনার আদ্যপান্ত জানিয়ে চাঞ্চল্যকর বয়ান দিয়েছেন বিপ্লব ও কাইয়ুমও।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বিপ্লবের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের ফুটপাত বাজার থেকে আগে মাসিক ভিত্তিতে ১২ হাজার টাকা পেতেন কিলার বিপ্লব। কিন্তু ওই বাজারের নিয়ন্ত্রক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের প্রস্তাবিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল মাঝি সম্প্রতি বিপ্লবকে চাঁদার ভাগ দেয়া বন্ধ করে দেন।
এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিপ্লব। ত্রাস ছড়িয়ে বাজারটি দখলে নিতে সাইফুল ও তার অনুসারিদের খতম করার পরিকল্পনা করেন বিপ্লব ও তার অনুসারীরা। খুনের এই পরিকল্পনাও করা হয় মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের পাশে জিনজিয়ান রেস্টুরেন্টের গলিতে বিল্পবের অফিসের বসে। অস্ত্রের জোগানও দেন তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৭ জানুয়ারি কৌশলে ডেকে এনে রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে ফিল্মি স্টাইলে সাইফুল ও তার সঙ্গে আসা কয়েকজন যুবকর্মীর উপর সংঘবদ্ধ হামলা চালায় তারা। ভয়ঙ্কর সেই হামলায় সেদিন প্রাণ হারান যুবলীগ নেতা ও সাইফুলের ডান হাত যুবলীগ কর্মী রোমান।
গুরুতর আহত হন সাইফুল ও আল আমিনও। ঘটনার পর পরই গা ঢাকা দেন কিলার বিপ্লব ও তার অনুসারীরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘মূলত ফুটপাতের বাজার কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের জেরেই যুবলীগ কর্মী রোমান খুন হয়েছেন। ঘটনায় জড়িত এজাহারভুক্ত দুই আসামী ছাড়াও মোট ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন রিমান্ডে আছেন। একজন শুক্রবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ‘
তিনি আরও জানান, কৃষকলীগ নেতা বিপ্লব এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। ফুটপাতের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করায় যুবলীগকর্মী সাইফুলকে হত্যা করাই ছিল তার টার্গেট। যদি কেউ তার সঙ্গে আসে তাদেরও খতম করার নির্দেশও ছিলো বিপ্লবের। আর নিজ অফিসে ভাড়াটে খুনি ও অনুসারীদের ডেকে এনে পুরো ঘটনার ছক কষেন বিপ্লব। এই বিপ্লবের নামে মিরপুর ও পল্লবী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, অস্ত্র ও ডাকাতির ৭টি মামলা রয়েছে। পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও এসআই আবু সাঈদ জানান।
যুবলীগ কর্মী রোমান হত্যা মামলার বাদি নিহতের স্ত্রী মোসা. আশামনি জানান, পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকে তার ভাসুরের একটি গ্রিলের ওয়ার্কসপ গ্যারেজ রয়েছে। রোমান ওই দোকানে ভাইকে সহায়তা করতেন। রোমান পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি বাপ্পী চৌধুরীর অনুসারী সাইফুল মাঝির সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আর রোমান হত্যা মামলার জড়িত অন্যতম আসামি মোহাম্মদ আলী ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীমের অনুসারি।
তিনি আরও জানান, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ফায়ারসার্ভিস এলাকার ফুটপাতের দোকান এবং ৬ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের ডায়েবেটিকস বাজার থেকে তোলা টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে রোমানের দ্বন্দ্ব ছিল। এরই জের ধরে গত ৭ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে তার স্বামী যুবলীগ কর্মী রোমান এবং সাইফুল, রাজু, সাব্বির হোসেন, আসলাম, ইমরান হোসেন ও আল আমিনসহ আরও ২ জন ৪টি মোটর সাইকেলে ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় গেলে তাদের উপর ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীমের অনুসারী মোহাম্মদ আলী, আনছার আলী, লিমন ওরফে বড় লিমন, আনছার সুমন, ফয়ছাল হোসেন রুমান, পিচ্চি সুমন, ড্রাইভার আরিফ, সুজন, সুমন ওরফে চুটকি সুমন, লিমন ওরফে ছোট লিমন, ফয়েজ, মাসুম, আজহারুল ইসলাম সবুজ ছাড়াও ১৫ থেকে ২০ জন যুবক হামলা চালায়।
আনছার অতর্কিত রোমানদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এরপর ফিল্মিস্টাইলে একটি দোকান থেকে বেরিয়ে মোহাম্মদ আলীরা চাপাতি, চাকু, লোহার রড নিয়ে রোমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মোহাম্মদ আলী রোমানের পেছন থেকে হাত ধরে রাখে। আনসার আলী চাকু দিয়ে রোমানের বুকের মাঝ বরাবর আঘাত করে। রোমান এই অবস্থায়ও দৌড়ে ৬ নম্বর লেনের ৪/৬ নম্বর বাসার সামনে লুটিয়ে পরে।
এ সময় ফয়েজ রান্না করার লোহার হাতা দিয়ে উপর্যপুরি বাড়ি দিয়ে আল আমিনকে ফেলে দেয়। পিচ্চি সুমন চাকু দিয়ে আল আমিনের পেটে ঢুকিয়ে দিলে তার নাড়িভ‚ড়ি বেরিয়ে যায়। মোহাম্মদ আলী ও আনসার আলী চাকু দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপায় সাইফুল মাঝিকে। দুর্বৃত্তরা পিটিয়ে গুরুতর আহত করে অন্যদেরও। এক পর্যায়ে আহতদের চিৎকারে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলে স্থানীয়রা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্বামীর খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মামলার বাদি আশামনি।—- আমাদের সময়